×

দেবীর চক্ষুদান ও মহালয়া – তাৎপর্য 

মহালয়া mahalaya
Bengali celebrate Durgapuja.

পুরোনো সেই দিনের কথা 

দূর্গাপুজার মাস ঘনিয়ে এলেই মনে পরে যায় ছোটবেলার সেই উত্তেজনাময় দিনগুলির কথা! মহালয়া (Mahalaya) ও পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত মামাবাড়িতে সকলের সঙ্গে আনন্দ করা, মামীদের হাতের সুস্বাদু খাবার, ভাইবোনেরা মিলে মারপিট করে সিনেমা দেখা, সন্ধ্যে বেলায় ঠাকুর দেখতে বেড়ানো আর ফুচকা ও আরো অন্যান্য নোনতা জিনিস খাওয়া। 

তবে দুর্গাপূজার আনন্দের মুহূর্ত শুরু হত মহালয়ার আগের রাত থেকেই । সেই দিন রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তাম যাতে পরেরদিন ভোর চারটেয় উঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া আর পৌনে পাঁচটা নাগাদ ডিডি ওয়ানে মহালয়া দেখতে পারি।  মহালয়া থেকেই শুরু হত পুজোর আনন্দ – মা আসছেন আর মাত্র সাত দিন।  আমাদের ছোট ছোট আঙুলে কর গুনতাম আর ভাবতাম কখন মামাবাড়ি যাবো, কখন বোনেদের সঙ্গে দেখা হবে! 

চক্ষুদান (Chokkhudan) কী ও কেন?

মাঝখানে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, বয়স তিনের ঘরে ঢুকে পড়লেও মনটা সেই ফ্রক পরা বয়সেই আটকে আছে। আজ মহালয়া, দেবীর আগমনের ঘন্টাধনির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে আকাশের নীলিমায়, পৃথিবীর কাশফুলের ঢেউয়ে।  এই শুভক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা প্রত্যেকেই মননে দেবীর চক্ষুদান প্রত্যক্ষ করলাম।  

কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, দেবীর চক্ষুদান কি, কেন করা হয়, এর তাৎপর্য কি? মহালয়ার দিনেই বা কেন দেবীর চক্ষুদান করা হয়।  আমার মনেও একই প্রশ্ন জেগেছিল।  সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি যা পেলাম তা তোমাদেরকে জানালাম।  

মহালয়ার অর্থ 

বর্তমানে মহালয়ার দিন দেবীর চক্ষুদান হলেও আসলে শাস্ত্রমতে চক্ষুদান পর্বটি মহাসপ্তমীর দিন নবপত্রিকা প্রবেশের পর হওয়া উচিত।  মহালয়া শব্দটির অর্থ হল মহান আলয় অর্থাৎ দেবী দূর্গা এখানে আমাদের মহান আলয়। আমরা সকলেই জানি মহালয়া হল পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা। 

chokkhudan on Mahalaya (মহালয়া )

দেবীপক্ষের শুরুতেই দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিতে চক্ষুদান করে তাঁর আগমন বার্তা চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। চক্ষুদানের মাধ্যমে দেবী প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।  চক্ষুদানের মাধ্যমেই দেবী মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হন।  

মহালয়ার দিন কেন চক্ষুদান?

অতীতে দুর্গাপূজা মূলত রাজবাড়ি বা বনেদি বাড়িতে হত, তখন রথের দিনে কাঠামো পূজা হত আর মহাসপ্তমীর দিন নবপত্রিকা প্রবেশের পর চক্ষুদান করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে বারোয়ারি (সর্বজনীন) পূজার সংখ্যা বাড়তে থাকলে এবং দেবীপক্ষের শুরুতেই দেবীর আগমন বার্তা দেওয়ার জন্য মহালয়ার(Mahalaya) দিনই প্রতিমার চক্ষু আঁকার চল শুরু হয়। 

চক্ষুদানের নিয়ম ও পদ্ধতি 

বরিষ্ঠ শিল্পী মহালয়ার পুন্য ভোরে পুরোহিতের উপস্থিতিতে কাপড়ের ঘেরাটোপে শুদ্ধাচারে  ও লেলিহান মুদ্রায় ডান হাতে কুশ ঘাসের অগ্রভাগ নিয়ে দেবী দুর্গাকে কাজল পরিয়ে থাকেন। হিন্দু ধর্মে কুশকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয় যা শুদ্ধতার প্রতীক।  

celebrating Mahalaya (মহালয়া)

প্রথমে ত্রিনয়ন, তারপর বাম চোখ ও শেষে দান চোখ আঁকা হয়। চক্ষুদানের সময়ে শিল্পী ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করতে থাকেন। দেবীর চোখ জ্ঞান শক্তি, ইচ্ছা শক্তি ও কর্মশক্তির প্রতীক।  চক্ষুদানের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে জ্ঞান ও ইচ্ছা, দূরদর্শিতা, ও কর্ম শক্তি জাগরণ হোক, সেই প্রার্থনা করা হয়ে থাকে।

এবার তোমরা জিজ্ঞাসা করতেই পারো লেলিহান মুদ্রা কি? আর দেবী দুর্গার বীজমন্ত্র কী?

চক্ষুদানের সময়ে শিল্পী ও পুরোহিত লেলিহান মুদ্রায় অবস্থান করেন।  এটি একটি বিশেষ হস্ত মুদ্রা যা শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে বলে বিশ্বাস প্রচলিত।  শুধু দেবী দুর্গার চোখ নয়, তাঁর সঙ্গে থাকা লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, কার্তিক এবং এমনকি অসুরকেও একই মন্ত্র ও আচারের মাধ্যমে চক্ষুদান করা হয়, যার মাধ্যমে মৃন্ময়ী প্রতিমায় সকলেরই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। স্ত্রী দেবতার ক্ষেত্রে প্রথমে বাম চোখ ও পুরুষ দেবতার ক্ষেত্রে প্রথম ডান চোখে কাজল পড়ানো হয়। 

দুর্গার চক্ষুদান মন্ত্র –

পুরোহিত দর্পন অনুসারে, দেবীর চক্ষুদান এর সময় নিম্নলিখিত মন্ত্রটি জপ করা হয়। 

পুরোহিত দর্পন – দেবী পুরাণোক্ত দুর্গাপূজা 

“ওঁ কথা নশ্চিত্র আ ভূবদূতী সদা বৃধঃ 

সখা। কয়! শচিষ্ঠয়। রূতা॥

ও আপ্যায়স্য সমেতু তে বিশ্বতঃ সোমবৃষ্তং । ভবা বাজস্ত সঙ্গথে স্বাহা।

শু চিত্র দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুর্থিত্রস্ত বরুণন্তাগ্নেঃ। 

আপ্রা দ্যাবাপৃথিবী অস্তরিক্ষই হুরধ্য আত্মা জগতস্তস্থুষশ্চ॥”

তোমাদের সুবিধার্থে এখানে পুরোহিত দর্পন থেকে কয়েকটি অংশের ছবি তুলে ধরলাম ও সেই সঙ্গে পিডিএফ ও দিয়ে দিয়েছি। তোমাদের যাদের আগ্রহ আছে পিডিএফ খুলে দেখতে পারো।  

পুরোহিত দর্পনের সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার ছবি

chokkhudaan ritual book

১. বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণোক্ত দুর্গাপূজা 

chokkhudaan ritual text

২. দেবী পুরাণোক্ত দুর্গাপূজা 

another chokkhudan related text


বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পুরোহিত দর্পনে এ কথা স্পষ্ট করেই বলা আছে বেদ মন্ত্রে শূদ্র ও স্ত্রীদিগের কোনো অধিকার নেই, এবং সেইজন্য তারা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করবে না। বিষয়টি খুবই হাস্যকর এইকারণে যে বেদমন্ত্রে নারীর কোনো অধিকার নেই, সেই বেদমন্ত্র পাঠ করেই নারী শক্তির আরাধনা করা হচ্ছে।  তোমাদের সুবিধার্থে আমি লেখাটা তুলে ধরলাম – 

purohit darpon - hindu religious text book

আবার দেখা হবে!

তোমাদের সকলের পুজো খুব ভালো কাটুক।  পরিবার পরিজন নিয়ে এই কয়টা দিন প্রত্যেকের মুখে যেন হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে, মায়ের মুখের পবিত্র হাসির বন্যায় যেন ধুয়ে যায় আমাদের মন, শরীর ও আত্মা। কলুষহীন হয়ে উঠুক আমাদের আগামী।    

Drawing girl's eye
seperator

Post Comment